ধ্বনি, বর্ণ, বর্ণমালা ও লিপি

ধ্বনি, বর্ণ, বর্ণমালা ও লিপি

ধ্বনি

মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যে কথা বলে তার মূলে রয়েছে কতকগুলো ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। মানুষ তার সামাজিক জীবনে দৈনন্দিন কথাবার্তার জন্য কথা বলে, মুখ খোলে ও আওয়াজ করে। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণে যে কোন আওয়াজই ধ্বনি নয়। ধ্বনি হওয়ার একমাত্র উপায় হলো তার অর্থবোধকতা। অর্থবোধক ধ্বনিগুলোই হলো মানুষের ভাষা।

বাগযন্ত্র

ধ্বনি সুষ্টির জন্য আমরা ফুসফুস, কণ্ঠনালী, জিহ্বা, তালু, মূর্ধা, দাঁত, নাক, ঠোঁট ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করি। এই প্রত্যঙ্গগুলোকে বাক-প্রত্যঙ্গ বলে। সবগুলো বাক-প্রত্যঙ্গকে একত্রে বলা হয় বাগযন্ত্র।

বাগযন্ত্রের প্রত্যঙ্গগুলোর বিবরণ

১. ফুসফুস : ফুসফুসকে ধ্বনির মূল উৎপাদক যন্ত্র বলা হয়। কারণ এর সাহায্যে আমরা শ্বাস গ্রহণ এবং শ্বাস ত্যাগ করি। শ্বাস-প্রশ্বাসের বিরামহীন প্রক্রিয়ায় ফুসফুস পাম্পের মতো বাড়ে এবং কমে। এ সময় গলনালী ও মুখের গহ্বর দিয়ে বের হয়ে যাওয়া বাতাস বিভিন্ন স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ধ্বনি উৎপাদন করে।

২. স্বরযন্ত্র : স্বরযন্ত্র বলা হয় কণ্ঠকে। ধ্বনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুসফুসের পরেই এর স্থান। একে অনেকে কণ্ঠনালিও বলে থাকে। মানুষের স্বরযন্ত্র অন্যান্য প্রানীর চেয়ে বেশি উন্নত, তাই মানুষের ধ্বনি স্পষ্ট।

৩. স্বরতন্ত্রী : স্বরযন্ত্রের ভেতরে অবস্থিত দুটো সূক্ষ্ন তন্ত্রীর নাম স্বরতন্ত্রী। একটি উল্টে ভি (^) আকৃতির। ফসফুসতাড়িত বাতাস মুখবিবর কিংবা নাক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে স্বরতন্ত্রীর মধ্যপথে প্রবেশ করে। তখন স্বরতন্ত্রী দুটো কখনো কাঁপে, কখনো বা তেমন কাঁপে না। এদের কাঁপার উপরই ধ্বনির ঘোষতা এবং অঘোষতা নির্ভর করে।

৪. মুখবিবর : মুখের ভেতরের ফাঁকা স্থানকে মুখবিবর বলে। ধ্বনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. জিহ্বা : জিহ্বা বাগ যন্ত্রের সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রত্যঙ্গ। জিহ্বার গোড়া, পাতা ও ডগা ধ্বনি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৬. তালু : ধ্বনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তালুর ভূমিকা অনেক। মুখ গহ্বরের ধুনকাকৃতি অবতল অংশের নাম উপরের তালু। উপরের তাল দু ভাগে বিভক্ত। যথা : কোমল তালু ও শক্ত তালু।

৭. মূর্ধা : শক্ত তালুর শেষ অংশের নাম মূর্ধা। ধ্বনি উৎপাদনের কাজে এর ভূমিকা যথেষ্ট।

৮. ওষ্ঠ : ওষ্ঠ বা ঠোঁট ধ্বনি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯. দাঁত : ঠোঁটের পেছনে রয়েছে দাঁত এবঙ দাঁতের মাড়ি। ধ্বনি তৈরির কাজে দাঁত এবং দাঁতের মাড়ি যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

১০. নাক : ধ্বনি তৈরিতে নাকের ভূমিকা রয়েছে। নাকের রয়েছে নাসাপথ। ফুসফুসতাড়িত বাতাস নাসাপথ দিয়ে বের হয়ে ধ্বনি উৎপন্ন করে।

ধ্বনির শ্রেণিবিভাগ

বাংলা ভাষার ধ্বনিগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

১. স্বরধ্বনি

২. ব্যঞ্জনধ্বনি।

১. স্বরধ্বনি : যে বাগধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস থেকে আগত বাতাস মুখের মধ্যে কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় না সেগুলোই হলো স্বরধ্বনি। অর্থাৎ যে ধ্বনি অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়াই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিস্ফুটভাবে উচ্চারিত হয় এবং যাকে আশ্রয় করে অন্য ধ্বনি প্রকাশিত হয় তাকে স্বরধ্বনি বলে। যেমন: অ, আ, এ, ও ইত্যাদি।

২. ব্যঞ্জনধ্বনি : সাধারণত যে স্বরধ্বনিকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয় তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। অন্যভাবে বলা যায়, যে সকল ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুসতাড়িত বাতাস বেরিয়ে যেতে মুখবিবরের কোথাও না কোথাও বাধা পায় তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন: ক, খ, জ ইত্যাদি।

বর্ণ

ধ্বনির লিখিত রুপ বা চিহ্নকে র্বণ বলে। অর্থাৎ যেসব প্রতীক বা চিহ্ন দ্বারা নির্দেশ করা হয় তাকে বর্ণ বলে। ধ্বনি বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত হয়। আর বর্ণ লিখিতরুপে প্রকাশিত হয়। বর্ণ তাই ধ্বনির লিখিত রুপ, ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন বা ধ্বনির প্রতীক।

বর্ণ দুই প্রকার যথা:

১. স্বরবর্ণ : স্বরধ্বনির দ্যোতক লিখিত সাংকেতিক চিহ্নকে স্বরবর্ণ বলে। স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রুপকে কার বলে। বাংলা ভাষায় মোট ১০টি কার রয়েছে। বাংলা ভাষায় মোট ১১টি স্বরবর্ন রয়েছে। যথা:- অ-ঔ।

২. ব্যঞ্জনবর্ণ : ব্যঞ্জনধ্বনির দ্যোতক লিখিত সাংকেতিক চিহ্নকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রুপকে ফলা বলা হয়। বাংলা ভাষায় মোট ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। যথা: ক হতে চন্দ্র বিন্দু পর্যন্ত।

বর্ণ ও অক্ষর

সাধারণত বর্ণ ও অক্ষরকে এক মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বর্ণ ও অক্ষর এক নয়। ধ্বনির প্রতীক হচ্ছে বর্ণ আর বাগ যন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে একটি শব্দের যে অংশ একাবারে উচ্চারিত হয় তাকে অক্ষর বলে। একে শব্দাংশও বলা হয়।

বাংলা বর্ণমালা

বাংলা বর্ণমালায় পঞ্চাশটি (৫০টি) সরল বর্ণ রয়েছে।

এর মধ্যে স্বরবর্ণ ১১টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি।

স্বরবর্ণ: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ =১১টি।

ব্যঞ্জনবর্ণ:
ক, খ, গ, ঘ, ঙ ক বর্গীয় বর্ণ ৫টি।
চ, ছ, জ, ঝ, ঞ চ বর্গীয় বর্ণ ৫টি।
ট, ঠ, ড, ঢ, ণ ট বর্গীয় বর্ণ ৫টি।
ত, থ, দ, ধ, ন ত বর্গীয় বর্ণ ৫টি।
প, ফ, ব, ভ, ম প বর্গীয় বর্ণ ৫টি।
য, র, ল ৩টি।
শ, ষ, স ৩টি।
ড়, ঢ়, য়, ৎ ৪টি।
ং, ঃ, ঁ ৩টি।

মাত্রাহীন = ১০টি।
অর্ধমাত্রা = ৮টি।

Views: 44 Views
❤️ 0
👎 0
😢 0
😡 0

Leave a Reply

Scroll to Top