বাংলা দ্বিতীয় পত্রঃ বাক্যতত্ত্ব

বাংলা দ্বিতীয় পত্রঃ বাক্যতত্ত্ব

বাক্য কী?

বাক্য ভাষার প্রধান উপদান। আমরা যা কিছু বলি, অর্থাৎ ভাষা ব্যবহার করি, সেগুরো বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে। তাই বাক্যই হলো ভাষার বৃহত্তম একক। আবার একটি বাক্যের মৌলিক উপাদান হলো শব্দ। একাধিক শব্দ বা পদ নিয়ে বাক্য গঠিত হয়। তাই যে কোন পদসমষ্টিকেই বাক্য বলা যাবে না। বাক্য হতে হলে পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ বা অম্বয় থাকতে হবে। পরস্প সম্পর্কযুক্ত পদসমষ্টিকেই বাক্য বলে।

বাক্যের সংজ্ঞাঃ

যে সকল সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যাস্ত পদসমষ্টি দ্বারা বক্তার মনের ভাব স্পূর্ণরুপে প্রকাশ পায় তাকে বাক্য বলে। যেমন :

  • পাখিটি নীল আকাশে উড়ছে।
  • আমরা কলেজে যাব।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে পদ বা শব্দসমষ্টির দ্বারা কোন বিষয়ে বক্তার ভাব সম্পূর্ণরুপে প্রতিফলিত হয়, সেই পদ বা পদসমষ্টিকে বাক্য বলে।”

সার্থক বাক্যের বৈশিষ্ট্য/লক্ষণ/গুণঃ

একটি সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ/বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ রয়েছে। এই গুণগুলোর মধ্যে বাক্যে একটি গুন না থাকলে তাকে সার্থক বাক্য বলা হয়। তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো:

ক. আকাঙ্ক্ষা,
খ. আসত্তি,
গ. যোগ্যতা।

বাক্যের অংশঃ

প্রতিটি বাক্যের প্রধান দুটি অংশ থাকে। যথা:

১. উদ্দেশ্য ও

২. বিধেয়।

১. উদ্দেশ্য : যার সম্পর্কে বা যাকে উদ্দেশ্য করে কোন কিছু বলা হয় তাকে উদ্দেশ্য বলে। বাক্যের উদ্দেশ্য সাধারণত ক্রিয়ার পূর্বে অবস্থান করে। একটি বাক্য একা বা একাধিক উদ্দেশ্য পদ থাকতে পারে। আবার বিশেষ্য বা বিশষ্যস্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসমষ্টি যোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার বাক্যে কখনো কখনো উদ্দেশ্য পদ অনুল্লিখিতও থাকতে পারে।

উদাহরণ :
ক. পাখিরা আকাশে ওড়ে। এখানে একটি উদ্দেশ্য বিদ্যমান।
খ. জামিল, জ্যাভি, জুঁই আজ কলেজে যাবে। এখানে একের অধিক উদ্দেশ্য।
গ. সৎ লোকেরাই প্রকৃত সুখী। এখানে বিশেষ্যরুপে ব্যবহৃত বিশেষণ।
ঘ. (তুমি) কার সাথে কথা বলছিলে?- এখানে ‘তুমি’ বাক্য অনুল্লিখিত।

২. বিধেয় : কর্তা বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বাক্যে যা কিছু বলা হয় তাকে বিধেয় বলে। বাক্যের বিধেয় অংশে অন্তত একটি সমাপিকা ক্রিয়া ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া থাকতে পারে। একটি বাক্যে উদ্দেশ্য বাদ দিলে বাকি অংশটিই সাধারণত বিধেয় হয়।

উদাহরণ :
ক. পাখিরা আকাশে ওড়ে। এখানে পাখিরা বাদে বাকি সব বিধেয়।
খ. আমি যেতে পারব না। এখানে আমি বাদে বাকি সব বিধেয়।

বাক্যের শ্রেণিবিভাগঃ

গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার। যথা:

  1. সরল বাক্য,
  2. মিশ্র বা জটিল বাক্য ও
  3. যৌগিক বাক্য।

১. সরল বাক্য : যে বাক্যে একটি মাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন :

  • পাখিরা আশাড়ে ওড়ে,
  • নিপা কলেজে যায়।

সরল বাক্য যতেই বড় হোক না কেন তার একটি মাত্র কর্তা এবং একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকে। যেমন :

  • মেঘমুক্ত নীল আকাশে এক ঝাঁক বলাকা ওড়ে।

আবার বাক্যে একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া থাকবে মাত্র একটি। যথাঃ

  • রায়হান গল্প করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে কলিংবেল টিপলো।

২. মিশ্র বা জটিল বাক্য : যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ড বাক্য এবং এক বা একাধিক অপ্রধান খণ্ড বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে সর্ম্পর্কযুক্ত থাকে তাকে জটিল বাক্য বলে।

মিশ্র বা জটিল বাক্যের গঠন :

ক. যে/যা/যিনি/যাঁরা+অপ্রধান খন্ড বাক্য + সে/তা/তিনি/তাঁরা + প্রধান খণ্ড বাক্য। যেমন :

  • যে যত খাটে সে তত ফল পায়। যারা লেখাপড়া করে তারা সফল হয়।

খ. যখন/যেমন/বরং/যেই না/যেহেতু + অপ্রধান খণ্ড বাক্য + তখন/তেমন/তবুও/অমনি/যেহেতু + প্রধান ণ্ড বাক্য। যেমন :

  • যেমন কর্ম তেমন ফল।
  • যখন মানুষ প্রেমে পড়ে তখন সে অন্ধ হয়ে যায়।

৩. যৌগিক বাক্য: দুই বা ততোধিক সরল বা জটিল বাক্যের মিলনে যে পূর্ণ বাক্য গঠিত হয়, তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যৌগিক বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে ও, এবং, আর, কিংবা, কিন্তু, অথবা, বরং, তথাপি, অথচ, নতুবা, তুবও ইত্যাদি অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয়। যেমন : রহিমও করিম বাড়ি যায়।

যৌগিক বাক্যের গঠন :

সাধারণত চার ভাবে যৌগিক বাক্য গঠন করা যায়। যেমন:

ক. সরল বাক্য + সংযোজক অব্যয়+সরল বাক্য = তিনি শিক্ষক আর লামিমা ডাক্তার।
খ. সরল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + জটিল বাক্য = তিনি ডাক্তার কিন্তু যে ছেলেটি এসেছিল সে ব্যবসায়ী।
গ. জটিল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + সরল বাক্য = যে দোষী সে শাস্তি পেল না কিন্তু আমি শাস্তি পেলাম।
ঘ. জঠিল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + জটিল বাক্য = যখন টাকা চেয়েছি, তখন পাইনি আর এখন চাই না তো দিতে এসেছে।

সাধু ও চলিত রীতি মিশ্রণজনিত অসঙ্গতি

ভাষা প্রয়োগে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। একই বাক্যে যে কোন একটি রীতিতেই লেখতে হবে। যেমন :

অশুদ্ধ : শিক্ষককে দেখে সে চলিয়া গেল।
শুদ্ধ : শিক্ষককে দেখে সে চলে গেল।

অশুদ্ধ : সে কথা তাহারা ভুলিয়া গিয়েছে।
শুদ্ধ : সে কথা তারা ভুলে গেল।

পদাশ্রিত নির্দেশকজনিত ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

বাক্যে বিশেষ্যের সঙ্গে সাধারণত টি, টা, খানা, খানি ব্যবহার করে শব্দটি নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু তার আগে ভূল করে আবার পুনারায় নির্দিষ্টকরণ শব্দ প্রয়োগ করা হয়। তাই কোন বিশেষ্যের সঙ্গে টি, টা, খানা, খানি ব্যবহৃত হবার পর তার পূর্বে ‘এই’, ‘ঐ’ ব্যবহার করা যাবে না। আবার গুলো ব্যবহার করলে গুলি বা গুলিন পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।যেমন :

অশুদ্ধ : এই লোকটি কে?
শুদ্ধ : লোকটি কে? অথবা এই লোক কে?

অশুদ্ধ : ঐ লোকটি খুব সৎ।
শুদ্ধ : লোকটি খুব সৎ।

অশুদ্ধ : এই/ওই বইখানি দাও।
শুদ্ধ : বইখানি দাও।

বাচ্যের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

বাচ্যের ক্রিয়াপদের রুপের দিক যথেষ্ট নজর দিতে হবে। বাচ্যের ক্ষেত্রে বাংলার ক্রিয়াপদের সাথে ‘ইত’ যোগ করে ক্রিয়াকে কার্মবাচ্যের ক্রিয়া করতে হয়। যেমন :

অশুদ্ধ : সূর্য পূর্বদিকে উদয় হয়।
শুদ্ধ : সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়।

অশুদ্ধ : আমি সন্তোষ হলাম।
শুদ্ধ : আমি সন্তুষ্ট হলাম।

সংখ্যাজনিত ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

এই ভুলটির মধ্যে রয়েছে সংখ্যাবাচক শব্দের ক্ষেত্রে অর্ধেক অঙ্কে অর্ধেক কথায়, আবার সংখ্যা অঙ্কে লিখে শেষে ই/লা/শ প্রযোগ। কিন্তু সংখ্যাবাচক শব্দ বাক্যে ব্যবহারের সময় কথায় লিখতে হবে। যেমন:

অশুদ্ধ : ১লা এপ্রিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
শুদ্ধ : পহেলা এপ্রিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

বচনজনিত ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

একবচন ও বহুবচনের তারতম্যের জন্য এই ভুলটি হয়। বাক্যে একাধিক বহুবচনের ফলে বাক্যের গুন নষ্ট হয়। সাধারণত বচনঘাটতি বা বাহুল্যের কারণে এ বচন-ভুল হতে পারে। তাই একই বাক্যে একটির বেশি বহুবচন ব্যবহার করা যাবে না। যেমন :

অশুদ্ধ : সব পাখিরা ঘর বাঁধে না
শুদ্ধ : সব পাখি ঘর বাঁধে না।

অশুদ্ধ : লক্ষ লক্ষ জনতা সব উপস্থিত ছিল।
শুদ্ধ : লক্ষ লক্ষ জনতা উপস্থিত ছিল।

Views: 205 Views
❤️ 0
👎 0
😢 0
😡 0

Leave a Reply

Scroll to Top