Skip to content

রচনাঃ একটি শীতের সকাল

বাংলা দ্বিতীয় পত্র

একটি শীতের সকাল

“ রাত্রি শেষ।
কুয়াশায় ক্লান্তমুখ শীতের সকাল
পাতার ঝরােকা খুলে ডানা ঝাড়ে ক্লান্ত হরিয়াল।
শিশির স্নাত ঘাসে মুখ রেখে শেষের কান্নায়
দু’চোখ ঝরেছে কার, পরিচিত পাখিদের পায়।”

—আহসান হাবীব

ভূমিকা:

ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলাদেশ। বঙ্গ প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালায় তার কী ছন্দোময়, সংগীতময় অনুপম রূপবিস্তার। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা, রঙের খেলা, সুরের খেলা। ষড়ঋতুর এই খেলায় হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জরাগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্ককাঠিন্য, পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। তবু শীতের সকাল নতুন আমেজ নিয়ে হাজির হয় গ্রামবাংলায়।

শীতের আগমন:

পৌষ মাঘ দুমাস শীতকাল। তার তাপবিরল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক মহামৌনী তপস্বীর তপশ্চর্যা এবং অনন্ত বৈরাগ্যের ধূসর অঙ্গীকার। বিবর্ণ কাননবীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাবার নির্মম ডাক এসে পৌছায়। এক সীমাহীন রিকতায় তাকে সব অসহায় দিয়ে দিতে ডালপালাগুলাে হয়, দিয়ে একদিন যেতে হয় হাহাকার। ওদিকে করে ধান কেঁদে কাটা ওঠে মাঠে। কী সীমাহীন শূন্যতা, কী বিশাল কারুণ্য। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা! এ চন্দ্রমল্লিকা সময়ে, কমলা ডালিয়া, কলা প্রভৃতি, কুল ফুল, পেঁপে পাওয়া প্রভৃতি যায়। ফল ও গােলাপ, গাঁদা,

শীতের সকালের আবরূপ:

শীতের রিক্ততা নতুন জীবন আগমনের ভূমিকা রচনা করে। ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যিমামা আলাে ছড়াতে থাকে। উত্তরের হিমশীতল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। বনের গাছপালা থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ে ভােরের শিশির। শিশির ভেজা দুর্বাঘাসে কিংবা টিনের চালে সূর্যালােক পড়লে মনে হয় মুক্তা ঝলমল করছে। মানুষ আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে বসে থাকে, কিংবা আগুন জ্বালিয়ে চারদিকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঝিমুতে থাকে। আস্তে আস্তে কর্মের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। মৌমাছিরা গুন গুন শব্দে ছুটে যায় সর্ষে ফুলের দিকে মধু সংগ্রহের উদ্দেশে।

শীতের সকালের কৃষাণ-কৃষাণী:

শীতের সময় কৃষকেরা মৌসুমি শস্য তােলার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শাকসবজি খেতের তদারক করতে হয়। সকাল বেলাতেই একবার দেখে আসতে হয় কী অবস্থা সবজি বাগানের। কৃষক বধূও এসময় বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করে পরিবারের সবাইকে উপহার দিতে ব্যস্ত থাকে। কখনাে কখনাে খেজুর রসের পায়েস তৈরি করে পরিবেশন করে সবাইকে। শীতের পিঠার সাথে খেজুরের গুড় মিশিয়ে খেতে কতই না মজা! তাইতাে কবি সুফিয়া কামাল মনের নিকুঞ্জ বনে আজও ধরে রেখেছেন সে আনন্দঘন পরিবেশকে তাঁর কবিতায়-

“ পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে
খুশিতে বিষম খেয়ে
আরাে উল্লাস বাড়িয়াছে মনে।
মায়ের বকুনি খেয়ে।”

নগরে শীতের সকাল:

শহরে তুলনামূলকভাবে গ্রামের চেয়ে শীতের প্রকোপ একটু কম। কলকারখানা ও গাড়ির ইঞ্জিন, কখনাে বা বৈদ্যুতিক আলাের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ে। তবে শহরেও শীতের সকালের আগমন ভিন্ন ধরনের হয়। সকালে অফিসমুখী মানুষের ছুটাছুটি শুরু হয়। যতই কুয়াশা পড়ুক আর ঠাণ্ডা পড়ুক না কেন, সময়মত পৌছতে হবে অফিসে। তবে ছুটির দিনে অনেকেই শীতের সকালে বিছানা ত্যাগ করে না। অনেক সময় ঘন কুয়াশায় শহর আচ্ছন্ন হলে গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়। তবে শহরের বস্তি জীবনে শীতের সকাল মােটেও সুখকর নয়। তারাও গ্রামের দরিদ্র মানুষের মতাে শীতের দাপটে মুহ্যমান থাকে। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন-

“ এক টুকরা কাপড়ে কান ঢেকে
কত কষ্টে আমরা শীত কাটাই
সকালের এক টুকরাে রােদুর
এক টুকরাে সােনার চেয়েও মনে হয় দামী।

গ্রামে শীতের সকালঃ

গ্রামের মানুষ শীতের সকালেও জেগে ওঠে এবং দিবসের কর্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করে। চাষীরা মাঠে যাবার প্রস্তুতি নেয়। গােয়াল থেকে গরু বের করে তারা মাঠের দিকে রওনা হয়। পল্লীবধূরা জল আনতে কলসি কাঁখে পুকুর ও নদীর ঘাটে ছুটে যায়। ছােট ছােট ছেলেমেয়ে ও বৃদ্ধরা আগুনের পাশে গােল হয়ে বসে গল্প গুজবে মেতে ওঠে। গৃহিণীরা সকালের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে গ্রামে শিশির ভেজা সকাল আসে। গ্রামীণ প্রকৃতিতে শীতের সকাল একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সকালে মাঠের দিকে তাকালে সবুজের সমারােহে মনটা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। শীতের সকালে ছেলেমেয়েরা খড়ের আগুনে আলু পুড়িয়ে খেয়ে তাদের রসনা তৃপ্ত করে। মােটকথা, শীতের সকাল গ্রামবাংলায় যত জাকজমক ও আমেজপূর্ণ হয় শহরে ততটা হয় না। গ্রামীণ জীবনে শীতের সকালের পিঠার কথা বলতে গিয়ে ছড়াকার আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন লিখেছেন—

“ শীতের পিঠা শীতের পিঠা
ঝাল নােতা বেজায় মিঠা
পাটি সাপটা, চিতই, ভাপা,
মালাই ঠাসা, কিংবা ফাপা
খেজুর রসে হাবুডুবু
মাখছে খালা ভাজছে বুবু। ”

শীতের সকালের প্রকৃতি:

শীতের সকাল আসে ধীর লয়ে। যেন তার কোনাে ব্যস্ততা নেই। শীতকালে বাংলাদেশে প্রচুর শাকসবজি জন্মে। মাঠে মাঠে সেই শাকসবজি সবুজ শাখা বিস্তার করে প্রকৃতিকে কোমল করে তােলে। ঘাসের ডগায়, ও সবজি পাতায় রাতের শিশির কণা সকালের সূর্যালােকে ঝলমল করে হাসতে থাকে। শীতকালে নদীনালা, খালবিল, পুকুরডােবা শুকিয়ে যায়। শীতের সকালে নদীকে দেখে মনে হয় যেন শীতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে এক শান্ত সুবােধ বালিকার মতাে। গাছপালা পত্রশূন্য বলে প্রকৃতির সর্বত্রই বৈরাগ্যের ভাব ফুটে ওঠে। শীতের সকালে কুয়াশা থাকায় নদীর বুকে নৌকা চলাচল কম থাকে। চরে আটকে যাবার ভয়ে লঞ, স্টীমার ও ফেরিগুলাে চলাচল বন্ধ রাখে।

শীতের সকালে গরিব লােকের অবস্থা:

শীত যেমন আনন্দের ঋতু তেমনি কষ্টেরও। গরিব লােকেরা গরম কাপড় কিনতে পারে না বলে শীতের সকালে তাদের দুঃখকষ্টের সীমা থাকে না। আবার এমনও অনেক লােক আছে যাদের ঘরবাড়ি নেই, শহরে ফুট ফরমাস খাটে আর রাতে ঘুমায় রাস্তার ফুটপাতে। তাদের জন্য শীত এক অভিশাপ।

শীতের সকালের উপকারিতা:

শীতকালে কোনাে খাদ্যই গরমকালের মতাে সহজে নষ্ট হয় না। টাটকা শাকসবজি ও বিভিন্ন ফলমূল পাওয়া যায়। শীতের সকালে কাঁধে ভাড় নিয়ে লােকেরা বাড়ি বাড়ি খেজুরের রস বিক্রি করতে আসে। শীতের সময় খেজুরের রস পান করে পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়। সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থেকে বেশ আরাম পাওয়া যায়। শীতের সকালে মিষ্টি রােদ দারুণ প্রশান্তি নিয়ে আসে। রােদে বসে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে শীতের সকাল বেশ উপভােগ্য হয়ে ওঠে।

উপসংহার:

শীতের সকালের একটা চিরন্তন সৌন্দর্য ও মাধুর্য আছে। শীতের সকালের সে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেতে হলে সুদূর গ্রামে যেতে হবে। গ্রামেই শীতের সকাল তার অনবদ্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। শহরের ইট পাথরের কৃত্রিম কাঠিন্যের মধ্যে গ্রামীণ শীতের সকালের স্নিগ্ধ মধুর রূপটির সন্ধান পাওয়া ভার। শীতের পিঠায়, কামড় দিতে দিতে কিংবা কোচড় ভরা মুড়ি নিয়ে শীতের পল্লীগ্রামের সকালের সবখানে রােদকে দেখা যায় বরণ করে নেওয়ার পরিচিত দৃশ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *