বাংলা দ্বিতীয় পত্র
কম্পিউটার: বিজ্ঞানের বিস্ময়
“ শিল্পবিপ্লবােত্তর যন্ত্রসভ্যতা মানুষের দৈনন্দিন কর্মজীবনে যে যান্ত্রিকতা নিয়ে এসেছে, কম্পিউটার নির্ভর সভ্যতা সেই যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তির আশ্বাস। তাই আগামী দিনের মুক্ত মানুষের মধ্যে দেখব তার সৃজনশীল শক্তির পূর্ণ বিকাশ।”
-কার্ল মার্কস
ভূমিকা:
গ্রামভিত্তিক সমাজের স্থিতাবস্থাকে ভেঙে দিয়ে শিল্পবিপ্লব মানবসমাজের গঠন ও প্রকৃতিতে এনে দিয়েছিল এক বিপুলবিস্তারী ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। মানুষ নিজেকে, নিজের শক্তির সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করল কলকারখানা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলােতে। এর পরের ইতিহাস যন্ত্রযুগের আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস। আর এই পটভূমিতেই কম্পিউটারের আবিষ্কার ও বিকাশ।
আজকের দিনে কম্পিউটার এবং কম্পিউটার নির্ভর স্বয়ংক্রিয়তা একদিকে যেমন যন্ত্রের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে বহুগুণিত করে মানুষের কর্মদক্ষতাকে, উৎপাদন ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে; অন্যদিকে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও প্রয়ােজনীয় হিসাব-নিকাশজাতীয় গতানুগতিক কাজকর্মের দায়িত্ব গ্রহণ করে অনাবশ্যক মানসিক শ্রমকে ব্যবহারিক অর্থে অনেক সহজ করে তুলেছে।
কম্পিউটার কী:
কম্পিউটার বলতে এমন একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র বােঝায়, যা অগণিত উপাত্ত গ্রহণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কম্পিউটার ’ শব্দটি ইংরেজি এবং এর অর্থ হলাে ‘ গণকযন্ত্র। কম্পিউটার হিসাবের যন্ত্র হিসেবে যােগ, বিয়ােগ, গুণ, ভাগ জাতীয় অঙ্ক কষতে পারে। এছাড়া তথ্যাদির বিশ্লেষণ ও তুলনা করা এবং সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা রয়েছে এই যন্ত্রটির। গণিত, যুক্তি ও সিদ্ধান্তমূলক কাজের সঙ্গে কম্পিউটারের সংযােগ। কাজের গতি, বিশুদ্ধতা ও নির্ভরশীলতার দিক থেকে কম্পিউটারের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।
আবিষ্কার ও বিবর্তনঃ
কম্পিউটারের প্রাথমিক ধারণা আসে চার্লস ব্যাবেজ পরিকল্পিত একটি গণকযন্ত্র থেকে। নির্ভুল এবং দ্রুত গণনার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাবেজকে এই পরিকল্পনায় প্রেরণা যুগিয়েছিল। যােগ বিয়ােগ করতে সক্ষম গণনাযন্ত্র প্রথম তৈরি করেন গণিতবিদ ক্লেইলি পাসকেল ১৬৪২ সালে। ১৬৭১ সালে গডফ্রাইড লেবনিটজ প্রথম গুণ ও ভাগের ক্ষমতাসম্পন্ন যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। আধুনিক ক্যালকুলেটরের মূলনীতি ১৮১২ সালে চার্লস ব্যাবেজ প্রথম পরিকল্পনা করেন।
১৯৪৪ সালে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় ও আই, বি, এম, কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ইলেকট্রো মেকানিক্যাল কম্পিউটার তৈরি হয়। এরপর থেকে কম্পিউটারের গঠন ও প্রকৃতি অত্যন্ত দ্রুত বিবর্তিত হয়েছে। এর প্রয়ােগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে বহুলাংশে। ইলেকট্রনিকস্ শিল্পের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কম্পিউটার হয়েছে সহজলভ্য। এখন বিজ্ঞানীর গবেষণাগার ছেড়ে সামাজিক জীবনে তার প্রতিষ্ঠা।
কম্পিউটারের শ্রেণিবিভাগ:
কম্পিউটারের ভিতরের গঠন, আকৃতি, কাজের গতি ইত্যাদি বিচারে একে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন: সুপার কম্পিউটার, মেইনফ্রেম কম্পিউটার, মিনি কম্পিউটার ও মাইক্রো কম্পিউটার। গঠন ও আকৃতিগত পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে মূলনীতিতে বিশেষ পার্থক্য নেই বললেই চলে। কম্পিউটার ছােট বা বড় আকারের হয়ে থাকে।
কম্পিউটার যেভাবে কাজ করে:
কম্পিউটারের ক্রিয়াকলাপ এক দিক থেকে মানুষের মগজের সঙ্গেই তুলনীয়। মানুষ তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য সুসংবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে তার স্মৃতিতে। এর ওপর নির্ভর করেই সে যেকোনাে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কম্পিউটারের একটি স্মৃতিভাণ্ডার আছে যেখানে দুটি জিনিস সংরক্ষিত রাখতে হয়— প্রথম, কোনাে একটি বিশেষ সমস্যা। সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, যাকে নিয়ে কম্পিউটার কাজ করবে। দ্বিতীয়, সে বিশেষ সমস্যা সমাধানের একটা ক্রমবিন্যস্ত, পদ্ধতি, যে ক্রমবিন্যাস অনুযায়ী সে কাজ করবে।
সুতরাং একটা বিশেষ সমস্যা কম্পিউটার তখনই সমাধান করতে পারবে, যখন তার স্মৃতিতে কী নিয়ে কাজ হবে এবং কীভাবে কাজ হবে— এ দুটি বিষয়ই থাকবে। প্রথমটিকে বলা হয় তথ্য, দ্বিতীয়টিকে বলা হয় প্রােগ্রাম ও এ বিষয়টিকে বলা হয় কম্পিউটার সফটওয়্যার। অন্যান্য যন্ত্রের মতাে কম্পিউটারের একটা হার্ডওয়্যার বা যান্ত্রিক কাঠামাে ও গঠন আছে, যা যন্ত্রটির ক্রিয়াকলাপ নির্ধারণ করে। কিন্তু কম্পিউটারের স্বাতন্ত্র হলাে, তথ্য ও প্রােগ্রামের রদবদল ঘটিয়ে একই কম্পিউটারকে দিয়ে অন্যান্য কাজ করানাে যায়।
কম্পিউটারের প্রয়ােগ বিস্তৃতির মূল কারণ চারটি। এক, অত্যন্ত দ্রুত, গণনা করার ক্ষমতা; দুই, বিপুল পরিমাণ তথ্যকে সুসংবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা; তিন, ভ্রমশূন্যতা এবং চার, তথ্য ও প্রােগ্রাম অনুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি; অর্থাৎ ঐ চারটি বৈশিষ্ট্যকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা। তাই কম্পিউটারের ব্যবহার আজ বিচিত্র ও বহুমুখী পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।
কম্পিউটারের ব্যবহার:
কম্পিউটারের ব্যবহারিক প্রয়ােগের ক্ষেত্র কোনাে বিশেষ একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। একদিকে কোনাে প্রতিষ্ঠানে সমস্ত কর্মীর মাসিক বেতন, সেখানকার আয় ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ অথবা অন্যান্য গণনা কম্পিউটারের সাহায্যে করা যায়। কম্পিউটার এই বিপুল তথ্যভাণ্ডারকে নির্ভুলভাবে এবং সুসংঘবদ্ধভাবে মনে রাখতে পারে। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপক। এর মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ ও জমা রাখা হচ্ছে। জমা রাখা হচ্ছে গবেষণালব্দ কাজকর্মের তথ্য।
মুদ্রণক্ষেত্রে অর্থাৎ বই ছাপার কাজে কম্পিউটার আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে অল্পসময়ের মধ্যে বিশাল কলেবরের বই পুস্তক প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেছে। অন্যদিকে আকাশে উড়ন্ত কলকারখানায় মহাকাশযান এবং উৎপাদনের তার গতিপথ পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ ও থেকে নিয়ন্ত্রণ শুরু করে কম্পিউটারের বড় বড় সাহায্যে সহজে করা যায়। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার বিভিন্ন ধরনের কাজকে আরও সহজ এবং সাবলীল করে তুলেছে। কম্পিউটারের তথ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং নির্ভুল ও দ্রুত গণনার ক্ষমতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার নানা গবেষণায় এক নতুন মাত্রা সংযােজন করেছে। কম্পিউটার, চালিত রােবট কলকারখানায় গতানুগতিক ও রুটিন মাফিক কাজকর্মের দায়ভার গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
কম্পিউটারের কুফল:
অনেক সুফলের পাশাপাশি কম্পিউটারের কিছু কিছু কুফলও আছে। সাধারণভাবে কম্পিউটার মানবশক্তির বিকল্প; অসংখ্য মানুষ যে কাজ করে, কম্পিউটার তা একাই নিস্পন্ন করে। কম্পিউটার প্রয়ােগের ফলে সেইসব মানুষ কর্মহীন হয়, সৃষ্টি হয় বেকার সমস্যা। বিশেষ করে দরিদ্র অনুন্নত দেশে কম্পিউটার এভাবে প্রবল সমস্যা সংকটের সৃষ্টি করে থাকে। কম্পিউটার ব্যবহারকারী শারীরিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এর ব্যবহারের ফলে। এ যন্ত্র থেকে যে রশ্মি নির্গত হয় তা কখনাে কখনাে শরীরের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
কম্পিউটার দিয়ে অনেক সময় চাকরি-প্রার্থীর যােগ্যতা বা পাত্রপাত্রীর সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়। কিন্তু একজনের ব্যক্তিত্ব বা হৃদয়ধর্ম এতে নির্ধারিত করা দুঃসাধ্য। যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য কম্পিউটারের বর্ণনাতে অনেক সময় প্রবল ত্রুটি থেকে যায়। যান্ত্রিক গােলযোেগ থাকায় অনেক সময় পরীক্ষার ফলাফলে মারাত্মক ত্রুটি দেখা যায়; তাতে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এমনিভাবে কম্পিউটারের নানা কুফল মানবজীবনকে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে।
উপসংহার:
আধুনিক জীবন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে কম্পিউটার জড়িত থেকে মানুষের জন্য যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, তা থেকে মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে হবে এই কম্পিউটারের মাধ্যমে। আমাদের সমস্যাসঙ্কুল দেশে কম্পিউটার হয়ত অন্ধকার থেকে আলােতে আনার পথ দেখাবে। প্রকল্প বিশ্লেষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাজেট, অর্থনৈতিক, সামাজিক, কারিগরি ও শিল্পবাণিজ্য-সংক্রান্ত যেকোনাে জরুরি সমস্যা সমাধান দেয় এ কম্পিউটার। মানুষের চিন্তাধারায় পরিকল্পনা বিশ্লেষণ, নিরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অবদান রাখছে কম্পিউটার। তাই কম্পিউটারের সুফল ভােগ করার জন্য আমাদের তৎপর হওয়া প্রয়ােজন।