রচনাঃ চরিত্র

বাংলা দ্বিতীয় পত্র


রচনাঃ চরিত্র

“ পৃথিবীতে আর কিছু নেই চরিত্রের চেয়ে দামি,
চরিত্র এক অমূল্য ধন চির কল্যাণকামী। ”

ভূমিকা:

মানবজীবনে কাজকর্মে, চিন্তাভাবনায়, আচার-ব্যবহারে একটা বিশেষ ভূমিকা যখন অভিব্যক্ত হয় তখন তাকে চরিত্র বলে। অভিহিত করা যায়। চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। যিনি চরিত্রবান তিনি সমাজে যেকোনাে বিরাট সম্পদশালীর চেয়ে বেশি সম্মান পেয়ে থাকেন। আর যার চরিত্র নেই, সে যত সম্পদশালী বা ক্ষমতাবানই হােক না কেন, তাকে কেউ শ্রদ্ধা করে না। চরিত্র মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করে, মানুষকে বিশিষ্ট করে তােলে এবং চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ নিজের পরিচয় লােকসমাজে তুলে ধরে। চরিত্রবান লােকদের জন্যই সমাজে শান্তি ও সৌন্দর্য বজায় থাকে। যার চরিত্র নেই, জীবনে গৌরব করার মতাে তার কিছুই নেই।

চরিত্র কী:

চরিত্র মানে স্বধর্ম। কোনাে লােকের বিশেষ আচরণ বৈশিষ্ট্যকে চরিত্র বলা যায়। মানবজীবনে চলায়-ফেরায়, কথা-বার্তায়, কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে এবং চিন্তাধারায় যে মহৎ ভাব পরিলক্ষিত হয়, তাকেই বলে চরিত্র। যার আচার আচরণে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভােগবাদ প্রাধান্য পায়, তাকে বলা হয় চরিত্রহীন; আর যিনি সত্য এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকেন, অপরের কল্যাণ কামনায় আত্মত্যাগ করেন, তাকে বলা হয় চরিত্রবান।

চরিত্রবান মানুষের এমন কতকগুলাে গুণ থাকে, যা সমাজের অন্যান্য লােকেরা পছন্দ করে। অনেক ধরনের লােকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সমাজের সকলকেই এসব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। সমাজে পরস্পরের মধ্যকার আচরণবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই মানবিক চরিত্র। সামাজিক আচরণবিধির প্রতি যাদের শ্রদ্ধাবােধ নেই তারা নিজেদের পশুসত্তা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এসব লােকই চরিত্রহীন। তাই বলা যায়, মানুষের সামাজিক আচরণবিধির প্রতি শ্রদ্ধাবােধই চরিত্র।

চরিত্রের বৈশিষ্ট্য:

চরিত্র বলতে যে ধারণা বােঝায় তাতে আছে কতকগুলাে গুণের সমাবেশ। সত্য ও ন্যায়ের পথে যে বিচরণ করে, কাজেকর্মে যে আন্তরিকতা দেখায়, সকল মানুষের জন্য যার মনে সহানুভূতি সঞ্জিত থাকে, পরের কল্যাণের জন্য যার আগ্রহের অন্ত নেই, এমন লােকের মধ্যে চরিত্র, আছে বলে মনে করা হয়। মানবজীবনে সবগুলাে গুণের সমাবেশে চরিত্র গড়ে ওঠে বলে। চরিত্রবান মানুষই সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বের মানবজীবনকে আনন্দময় করার জন্য তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

তাই মানুষের লক্ষ্য জীবনের সকল আচার আচরণের মাধ্যমে এমন চমক্কার বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেওয়া যাতে সুন্দর চরিত্র গড়ে উঠতে পারে এবং পরিণামেশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়। ফুলের সৌরভ যেমন চারদিকে ছড়িয়ে মানব-হৃদয়কে মােহিত করে, তেমনি মহৎ চরিত্রের সৌন্দর্য সকলের মন আকৃষ্ট করে এবং সবার হৃদয়ে একটা শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতি অনীহা, প্রলােভনকে জয় করা, নৈরাজ্যকে উপেক্ষা করা; এসবই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনার যােগ্য।

সচ্চরিত্রের লক্ষণ:

যেসব মহাপুরুষ পৃথিবীর বুকে যুগে যুগে অমর কীর্তি রেখে গেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন চরিত্রবান। নামমাত্র নৈতিকতা বা ন্যায়নিষ্ঠাই চরিত্র নয়। ন্যায়, সত্য, সুন্দর ও জ্ঞানের পথ থেকে যারা কোনাে দিনই বিচ্যুত হন নি অর্থাৎ যাবতীয় মানবিক গুণাবলির সমন্বয় যাদের চরিত্রে ঘটেছে, তারাই সচ্চরিত্রবান। তাই তারা যুগ যুগ ধরে মানবসমাজের জন্য কর্মশক্তির প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (স), হযরত ইব্রাহীম (আ), হযরত আবুবকর (রা), হযরত উমর ফারুক (রা), হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র), হাজী মুহম্মদ মহসীন প্রমুখ মহাপুরুষগণের নাম করা যায়। তারা সকলেই তাদের বলিষ্ঠ চরিত্রের গুণে শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন।

চরিত্র গঠন:

চরিত্র গঠনের জন্য মানুষকে প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। মানবশিশুর জন্মের পর থেকে শৈশব ও কৈশাের অতিক্রমের সময় পর্যন্ত চরিত্র গঠনের কাল। জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে এমন একটি পর্যায় আসে যখন জীবনের বৈশিষ্ট্যের মূল কাঠামাে দাঁড়িয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে হয়তাে আর তেমন পরিবর্তন আসে না। তাই চরিত্র গঠনের জন্য জন্মের পর থেকে কাজ শুরু হয়।

মাতাপিতার হাতে চরিত্রের প্রথম রূপায়ণ এবং শিক্ষক ও অন্যান্য অভিভাবক আর পরিবেশের প্রভাব পড়ে আস্তে আস্তে একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট কাঠামাে দাঁড়ায়। যতদিন পর্যন্ত শিশুর নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ না ঘটে ততদিন পর্যন্ত চরিত্র গঠনের জন্য অভিভাবকের সযত্ন প্রয়াস চালাতে হয়। কীভাবে শিশুর মধ্যে মহৎ গুণাবলির বিকাশ ঘটবে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সমুদয় শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য যাতে জীবনে সফলভাবে প্রতিফলিত হতে পারে সে বিষয়েও লক্ষ রাখতে হবে। সুশিক্ষা লাভ হলে চরিত্র গঠন সহজ হয়।

চরিত্র গঠনের উপায়:

চরিত্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয় নিজেদের ঘর থেকে। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের স্তর অনুযায়ী শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। মাতাপিতা, আত্মীয়-স্বজন হতে শুরু করে সমস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যদিয়ে শিশুর চরিত্র গড়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় বা সমবয়স্কদের সঙ্গে খেলাধুলায় সঙ্গপ্রভাবে চরিত্র রূপ পরিগ্রহ লাভ করে। সেজন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের লক্ষ রাখা উচিত, লেখাপড়ার ভেতর দিয়ে শিশুদের কী ধরনের চরিত্র গড়ে উঠছে? চরিত্রকে সুমহান করে গড়ে তুলতে হলে সাধনার প্রয়ােজন হয়।

সাধনার ফলে মহৎ গুণাবলি অর্জিত হয় এবং তা জীবনকে সুন্দর করে। সৎসঙ্গ, সংযমশীলতা, সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, গুরুজনের প্রতি ভক্তি, সুগ্রন্থ পাঠ, সঠিক নির্দেশনা প্রভৃতি গুণাবলি সাধনার পথে সহায়ক হয়। চরিত্র গঠনের জন্য মানুষের এই সাধনা হয়ত বহু দুঃখ কষ্টের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এনে দেয়। চরিত্র সাধনার ধন। এটা বহুদিনের সাধনার দ্বারা অর্জন ও রক্ষা করতে হয়। সংসার প্রলােভনময়। পাপের অসংখ্য প্রলােভন মানুষকে বিপথে চালিত করতে সচেষ্ট।

নিজের আত্মিক শক্তির বলে সেই সকল প্রলােভনকে দমন করে নিজেকে সত্যের পথে অবিচল রাখতে হবে। এর জন্য প্রথম প্রয়ােজন আপন শক্তিতে দৃঢ় আস্থা স্থাপন। কারণ, আত্মবিশ্বাস চরিত্র গঠনের একটা বড় উপাদান। এটি মানুষকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে মানসিকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। পৃথিবীতে যারা কর্মবলে স্মরণীয় হয়ে আছেন বা কর্মসাধনায় মানবজাতির কল্যাণ সাধন করে গেছেন, তাঁদের জীবনকাহিনী আলােচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা সকলেই ছিলেন চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ।

চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা:

চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে চরিত্র গঠিত হয়। পরিবারের বাইরে প্রতিবেশীগণ ও সহচরগণ। শিশুদের চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। পরিবেশ যদি অনুকূল হয়, সুন্দর হয়, তবে জীবনের বিকাশ সুষ্ঠু হবে। পরিবেশ প্রতিকূল হলে মানুষের চরিত্র বিনষ্ট হয়।

মন্দ পরিবেশ থেকে ভালাে চরিত্রের মানুষ আশা করা যায় না। তাই পরিবেশ যাতে কলুষিত না হয় সেদিকে সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। কুসংসর্গের প্রভাব চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। অসৎসঙ্গে পড়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়। ফলে চরিত্রের সার্থক ও সুন্দর বিকাশ আশা করা যায় না। সৎ সঙ্গের প্রভাবে জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়, উত্তম চরিত্র গঠিত হয়। তাই অসৎ সঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে।

চরিত্রহীনতার কুফল:

চরিত্রহীন মানুষ পশুর চেয়েও অধম। চরিত্রবান না হলে মানুষ ভােগ লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয়। নামে মানুষ হলেও তখন আর তাদেরকে মানুষ বলা চলে না। জীবনে তারা কারাে শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা, পায় না, সমাজের সকলেই তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। এ ধরনের লােক মানবজাতির কলঙ্ক। মানবসমাজে তাদের স্থান নেই। বিদ্যাবুদ্ধি, ধনসম্পদ তাদের যতই থাক না কেন, কিছুতেই তারা লােকের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না। শুধু তাই নয়, চরিত্রহীন মানুষকে অভিশাপ ও অপমানের বােঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।

উপসংহার:

চরিত্র মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে। চরিত্রই মানুষকে যথার্থ মানুষ করে তােলে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার মতাে আর কিছুই নেই। মানুষের শ্রদ্ধাভক্তি যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, তা হয় শুধু চরিত্রের জন্য। চরিত্রের জন্য মানুষের সুনাম অর্জিত হয়, সকলে শ্রদ্ধা করে ও জীবন সার্থক হয়। চরিত্রবান লােকেরা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

Views: 17 Views
❤️ Love (0)
😂 Haha (0)
😢 Sad (0)
😡 Angry (0)

Leave a Reply