রচনাঃ চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান

বাংলা দ্বিতীয় পত্র

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান

ভূমিকা:

এখন বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে বহুদূর পর্যন্ত। মানবসভ্যতার বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সমােজ্জ্বলতার সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা চিকিৎসাশাস্ত্রকেও বিজ্ঞান নব নব দানে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা জানি“ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল ” অর্থাৎ, অতিবড় ধনবানেরও শরীর স্বাস্থ্য ভালাে না থাকলে তার অতুল ঐশ্বর্য কোন কাজে আসে না। আর স্বাস্থ্য ভালাে রাখতে চাই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা বা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা।

বিজ্ঞান এক্ষেত্রে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরম বন্ধুর মতাে। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ মুক্তি পেয়েছে বহু দুরারােগ্য ব্যাধি থেকে। মানুষের যে কয়টি মৌলিক অধিকার, তার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। পূর্বে মানুষের চিকিৎসা ছিল প্রকৃতিনির্ভর। সে সময় বিজ্ঞানভিত্তিক বা বিজ্ঞানসম্মত কোনাে চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। মানুষ তখন কবিরাজ, ওঝা, পীর, ফকির ও তাদের দেয়া, গাছগাছড়া, দোয়া-তাবিজ, পানিপড়া, ঝাড়ফুক প্রভৃতির ওপর একান্ত নির্ভরশীল ছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে যে তাদের সফলতা ছিল না, তা নয়। তবে তা অকিঞ্চিৎকর।

প্রাচীনকালের চিকিৎসা ব্যবস্থা:

মানুষ প্রাচীনকালে প্রকৃতির কাছে একেবারেই অসহায় ছিল। তখনকার দিনে চিকিৎসাও ছিল প্রকৃতিনির্ভর। মানুষ তখন প্রকৃতির গাছগাছড়া, লতাপাতা, দোয়া কালাম, তাগাতুগা, তাবিজ, ঝাড়ফুক, পানিপড়া প্রভৃতির ওপর আস্থাশীল ছিল এবং অনেক জটিল রােগেও তারা এসব জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করাত। বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে মানুষ তখন জটিল রােগে মারা তাে যেতই, এমনকি সাধারণ রােগবালাইতেও মারা যেত। শুধু মানুষই নয়, গৃহপালিত পশুপাখি জীবজানােয়ারও মারা যেত। সেদিনের প্রেক্ষিতে এসমস্ত রােগবালাইকে ‘ মড়ক ’ বলা হতাে। তখন কলেরা বসন্ত প্রভৃতির মতাে রােগেও শত শত এমনকি হাজার হাজার লােক মারা গিয়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, সেজন্যই মানুষ তখন এসব অবস্থাকে ‘ মড়ক’ বলত।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার শুরু:

চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান আজ যুগান্তর ঘটিয়েছে। দুরারােগ্য সব রােগব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা আজ বেশ কমে গেছে। আবিষ্কৃত হয়েছে যুগান্তকারী সব ওষুধপত্র যেমন স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরােমাইসিন, পেনিসিলিন, ফেললামাইসিন, প্যারাসিটামল প্রভৃতি ওষুধ এক্সরে, ইসিজি, এনজিও গ্রাম প্রভৃতি সব আবিষ্কার আজকে মৃত্যুপথযাত্রী সব রােগীকে নতুন জীবনে আশ্বাসে বলীয়ান করেছে। কর্নিয়া সংযােজন, বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃদপিন্ড, ফুসফুস ও যকৃতের মতাে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসাশাস্ত্র, আজ বিজ্ঞানের অবদানে সমৃদ্ধ।

চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পূর্বের তুলনায় হাজার গুণে উন্নত। অতিকম্পনশীল শব্দ এবং লেসার রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে, স্লেডিয়াম আবিষ্কার করে তাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানএমন এক বিপ্লব এনেছে যার দ্বারা শরীরের অভ্যন্তরে কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কী অবস্থা তা দেখা যাচ্ছে, রােগ নির্ণয় করে ব্যবস্থা দেওয়া, সম্ভব হচ্ছে। অপটিক ফাইবার ব্যবহার করে ক্যান্সার রােগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান চিকিৎসা জগতে কী যে এক বিপ্লব সাধন করেছে, তা বলে শেষ করার নয়, এতে যেমন করে মূত্রথলি ও পিত্তথলির পাথর চূর্ণ করার কাজে সফলতা এসেছে, তেমনই সফলতা পেয়েছে বহুমূত্র রােগীর অন্ধত্ব প্রতিরােধের।

কম্পিউটার প্রযুক্তিঃ

সবশেষে কম্পিউটার প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তাতে চিকিৎসা শাস্ত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করা সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞান আজ শুধু রােগীর রােগ নির্ণয়েই শেষ করে নি, সে মানুষের জন্মপূর্ব রােগ নির্ণয়েও অবদান রাখছে। রােগ প্রতিরােধে বিজ্ঞান Prevention is better than cure. অর্থাৎ, রােগ নিরাময়ের চেয়ে রােগ প্রতিরােধ করা শ্রেয় — এ প্রবাদটি বেশ পুরাতনই। রােগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই যদি তাকে প্রতিহত করা যায় তাহলে মানুষ অতিরিক্ত ভােগান্তির হাত থেকে রক্ষা পায়।

এমন চিন্তাধারা থেকেই রােগ প্রতিরােধে এগিয়ে আসে বিজ্ঞান আর যক্ষ্মা, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া, হাম, বসন্ত, কলেরা প্রভৃতি মারাত্মক রােগের প্রতিরােধ করতে বিজ্ঞান সফলতা দেখিয়ে মানবজগতকে বিস্মিত করেছে। একটু সচেতন হলে আজকের যে ভয়াবহ রােগ AIDS থেকেও মানুষ রক্ষা পেতে পারে। রােগ নিরাময় করতে বিজ্ঞান যেসব আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে উপহার দিয়েছে তা অতুলনীয়। যুগান্তকারী সব ওষুধ আবিষ্কারের ফলে জটিল সব রােগের চিকিৎসা তাে সহজতর হয়েছেই, সাধারণ রােগ যেমন- জ্বর, সর্দি, কাশি, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার ইত্যাদি সব সাধারণ রােগবালাই থেকেও বিজ্ঞানের অবদানে মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।

জটিল রােগের ক্ষেত্রে:

এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষ আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে তথা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে অনেক অনেক জটিল ও দুরারােগ্য রােগব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছে। অনেক মুমূর্ষ রােগীও কঠিনতর রােগ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন আশায় নবতর সঞ্জীবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছে। কুরি দম্পতি আবিষ্কৃত রেডিয়াম ক্যান্সারের মতাে No Answer এর ন্যায় মারাত্মক রােগেরও চিকিৎসা সম্ভব করেছে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণেই আজ মানুষ একজনের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অন্যজনের দেহে প্রতিস্থাপন করছে। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে মানুষ তার চেহারা বা আকৃতির পরিবর্তন করছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে।

বিজ্ঞান আজ চিকিৎসা ক্ষেত্রের বড় আশীর্বাদ:

বিজ্ঞান সৃষ্টির আদিকালে যখন মানুষ ঘাের তমসার তিমির কেটে কেটে অরুণােদয়ের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছিল তখন থেকে শুরু করে অদ্যবধি মানুষকে শুধু একটির পর একটি বিস্ময় উপহার দিয়েই চিলেছে। অনেক অনেক অসাধ্যকে, অনেক অনেক দুঃসাধ্যকে আজ হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। তবে বিজ্ঞান শুধু মানবসভ্যতাকে তথা বিশ্বসভ্যতাকে আশীর্বাদই উপহার দেয় নি, সে অভিশাপও বয়ে এনেছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে শুধু আশীর্বাদই দান করেছে।

উপসংহার:

যুগ ও কালের চাকা ঘূর্ণনের আবর্তে বিশ্বসভ্যতা বিকশিত হচ্ছে শিমুল ও পলাশ ধারায়, মানবসভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে চিকিৎসা ক্ষেত্রে পেয়েছে বিস্ময়কর উন্নতি। বলা চলে মানুষ প্রায় মৃত্যুকে জয় করেছে, করেছে করায়ত্ত।

Views: 15 Views
❤️ Love (0)
😂 Haha (0)
😢 Sad (0)
😡 Angry (0)

Leave a Reply