রচনাঃ বিশ্ব যােগাযােগে ইন্টারনেটের ভূমিকা

বাংলা দ্বিতীয় পত্র

বিশ্ব যােগাযােগে ইন্টারনেটের ভূমিকা

ভূমিকা:

আধুনিক যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ; বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে অভাবনীয় উন্নতি, প্রগতি এবং সুখ-সাচ্ছন্দ্য। বিজ্ঞানের যেসব আবিষ্কার মানুষকে সভ্যতার স্বর্ণশিখরে আরােহণ করতে সহায়তা করেছে তার অন্যতম হলাে ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলােচিত গতিময়তার এক মাইল ফলক ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মকাণ্ডকে ইন্টারনেট এমন এক সুতাের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে যে, সে সুতাে ছিড়ে গেলে হয়তাে সমগ্র বিশ্বব্যবস্থাই অচল হয়ে পড়বে।

ইন্টারনেট কী:

ইন্টারনেট হলাে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস। অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাপী সুবিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে ইন্টারনেট বলা হয়। অর্থাৎ, ইন্টারনেট হলাে কম্পিউটারের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক যাকে ইংরেজিতে বলা যায় World wide electronic network. ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সব কম্পিউটার অতি দ্রুততার সাথে যােগাযােগ করতে পারে এবং তথ্য আদান প্রদান করতে পারে।

ইন্টারনেট তৈরির ইতিহাস:

ইন্টারনেট উদ্ভাবনের প্রাথমিক কারণ ছিল সামরিক। সর্বপ্রথম মার্কিন সামরিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী নিজেদের অবস্থানগুলাের সঙ্গে সার্বক্ষণিক গােপন যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য ১৯৬৯ সালে প্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু করে। তখন এটি পরিচিত ছিল ‘ MILNET’ নামে। এ প্রযুক্তিকে আরও জনকল্যাণমুখী করে তােলার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলােকে দেওয়া হলে তারা শিক্ষা, গবেষণা এবং তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। তখন শিক্ষাজগতে এর নামকরণ হয় ‘অ্যাপারনেট’। পরবর্তীকালে এটি আন্তর্জাতিক যােগাযােগের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যা বর্তমানে ইন্টারনেট নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

ইন্টারনেটের প্রকারভেদ:

ব্যবহারকারীরা দুভাবে ইন্টারনেটের গ্রাহক হতে পারে। প্রথমটি হলাে অন-লাইন ইন্টারনেট। টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে সরাসরি কম্পিউটারে ইন্টারনেটের অন্য যেকোনো সার্ভিস প্রভাইডারের সঙ্গে যুক্ত করার পদ্ধতিকে অন-লাইন ইন্টারনেট বলা হয়। তাতে ব্যবহারকারীরা যেকোনাে সময় অন্য যেকোনাে প্রভাইডারের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। এছাড়াও IPACCES পদ্ধতিতে সরাসরি অন-লাইন ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ গ্রাহক তাতে আগ্রহবােধ করে না। দ্বিতীয় হলাে অফ-লাইন ইন্টারনেট যা ই-মেইল (e-mail) নামে পরিচিত।

এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকরা নিকটবর্তী কোনাে সার্ভারকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে বলেই এটাকে অফ-লাইন ইন্টারনেট বা ই-মেইল বলা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে গ্রাহকরা কম খরচে অফ-লাইন বা ই-মেইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে যােগাযােগ ও তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।

ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব:

ইন্টারনেট ও আজকের বিশ্ব তথা আধুনিক জীবনযাত্রা এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত। এর একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হলে যেন সব কিছু অচল হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা নানা রকম কাজ অতি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে পারি। তবে ইন্টারনেটে একেক রকম কাজ করার জন্য একেক রকম সফটওয়ারের (Software) প্রয়ােজন হয়। যেমন- Net News protocol- এর মাধ্যমে আমরা অতি সহজে ও দ্রুততার সাথে বিশ্বের যেকোনাে দেশের খবরাখবর জানতে পারি।

Telenet ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা অতি দ্রুত দেশ-বিদেশের যেকোনাে স্থানে অবস্থানরত আপনজনের সাথে কথা বলতে পারি, খোঁজ-খবর নিতে পারি বা যেকোনাে ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। File transfer protocol ব্যবহার করে আমরা এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ফাইল আদান-প্রদান করতে পারি। Internet Relay chat protocol ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন স্থানে বসে বিভিন্ন জনের সাথে। গল্পগুজব করতে পারি, আড্ডা দিতে পারি। E-mail ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা তথ্য আদান প্রদান করতে পারি। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ধরনের কাজকর্ম থেকে শুরু করে ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালত, গবেষণাপ্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সব কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইন্টারনেটের আশীর্বাদে আমরা ঘরে বসেই এখন বিশ্বের যেকোনাে বড় বড় লাইব্রেরির বইপত্র পড়তে পারি, দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি জানতে পারি। এর সাহায্যে এক প্রতিষ্ঠানের সাথে আরেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় বাণিজ্য সম্পর্কিত লেনদেন সম্পাদন করা যায়। ঘরে বসেই আমরা যেকোনাে দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বা আইন বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি। অর্থাৎ, বর্তমান বিশ্বে আধুনিক জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট।

ইন্টারনেট ও বাংলাদেশ:

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। কিন্তু তখন বাংলাদেশ ছিল অফ-লাইন ইন্টারনেটের অন্তর্ভুক্ত। ফলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তখন শুধু E-Mail সার্ভিসের সুবিধা পাওয়া যেত। বাংলাদেশ অনলাইন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১২ টি প্রতিষ্ঠান অন লাইন সংযােগ দিয়ে থাকে। ইতােমধ্যে দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ২০০৫-এর শেষের দিকে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে ওয়াইফাই অঞল ঘােষণা করে সেখানে বিনামূল্যে এবং মােবাইলের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযােগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে দেশ বিদেশের যােগাযােগ ও তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত হয়েছে।

ইন্টারনেট এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। ইতােমধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ভারত, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বদেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করতে পেরেছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে পিছিয়ে আছে। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি বেশ বেড়েছে এবং ইন্টানেটের বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার আশাব্যঞ্জক।

ইন্টারনেটের অপকারিতা:

ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের যেমন অসংখ্য সুবিধা বা ভালাে দিক রয়েছে, তেমনই কিছু কিছু অসুবিধা বা খারাপ দিকও রয়েছে যেমন- এর মাধ্যমে পর্ণোছবি ছড়িয়ে দেয়া, জুয়া খেলা, ব্লাকমেলিং করা, ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এসবের মাধ্যমে মানুষের বিবিধ ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু বিষয়টি নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। তাই এর খারাপ দিকের চেয়ে ভালাে দিকগুলােই অধিক গ্রহণযােগ্য ও বিশেষভাবে বিবেচ্য।

উপসংহার:

উন্নত জীবন ও বিশ্বব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তাে অধিকাংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট সুবিধা পৌছে যাবে এবং মানুষের জীবন হয়ে উঠবে আরও উন্নত ও সুখী সমৃদ্ধ।


আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনাঃ

Views: 59 Views
❤️ 0
👎 0
😢 0
😡 0

Leave a Reply

Scroll to Top