|

রচনাঃ বর্ষা ও বন্যা

proshna featured

7 min read

Advertisements

বর্ষা ও বন্যা

“ ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিতি ক্ষিতি সৌরভ রভসে। ”

–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা:

বাংলাদেশে বর্ষার আবির্ভাব যেমন রাজসিক, তার আয়ােজন তেমনি সুবিপুল। কাজল কালাে সজল মেঘের স্তরবিন্যাসে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হয়ে যায় অবগুণ্ঠিত। ঋতুরঙ্গের পট বদলে যায়। মেঘের গর্জনে ধ্বনিত হয় মৃদঙ্গের বাদ্য, তলােয়ারের মতােই খরদীপ্ত বিদ্যুৎশিখা আকাশের বক্ষদেশ বিদীর্ণ করে ঝলসে ওঠে, রাজার মতােই মহিমা নিয়ে আসে বর্ষা। এ সময়ে বন্যাও হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, তেমনি প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়াও বাংলাদেশের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্ষার আগমন:

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। তবে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই বাংলাদেশে বর্ষা শুরু হয়ে যায়। আকাশের দিগন্তে মেঘের সমারােহ মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বর্ষা যখন আসে, তখন কেবল আমাদের বাইরের আকাশটাই নয়, আমাদের মনের আকাশটাকেও সে তার মেঘমাধুর্যে পরিপূর্ণ করে আনে, অবিশ্রান্ত রস বর্ষণে তাকে কোমল ও সিক্ত করে তােলে।

বর্ষার রূপ:

বর্ষার আগমনে স্নিগ্ধ শীতল ধারা বর্ষণে রােমাঞ্চ জাগে ধরিত্রীর সর্বাঙ্গে। উদ্যতবাহু অরণ্যের বুকে জেগে ওঠে বহু প্রতীক্ষিত মর্মর মুখর মহােল্লাসে। তাপদা পৃথিবীর সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। মাঠঘাট, নদীনালা, খালবিল পূর্ণ হয়ে ওঠে কানায় কানায়। ধূলিধূসর পৃথিবীর খরতপ্ত দিনের হয় অবসান। নদীপথে মাঝিমাল্লাদের কণ্ঠ থেকে শােনা যায় সারিগানের অপূর্ব উল্লাস। ছিন্ন হয় মাটির কঠিন বাধা। শস্য শিশুর দল নবঅঙ্কুরের জয়পতাকা বহন করে ধরাপৃষ্ঠে হয় অবতীর্ণ। চারদিক শ্যামল সৌন্দর্যে প্লাবিত। তার মধ্যে ঘনিয়ে আসে পুষ্পবিকাশের আনন্দঘন পর লগ্ন। কেয়া-কদম্ব উঁই-গন্ধরাজ-হাস্নাহেনার স্নিগ্ধ গন্ধবাহারে, জলের কলােচ্ছ্বাসে, বনের পত্রমর্মরে বর্ষাপ্রকৃতির উন্মুখ হৃদয়ের কী অনবদ্য প্রকাশ!

বর্ষার নানা দিক:

সজল শ্যামল বর্ষার সঙ্গে আছে বাঙালির প্রাণের সম্পর্ক। তার সারা বছরের খাদ্য উৎপাদনে, তার অর্থনৈতিক জীবন সংগঠনে বর্ষার অবদান অসামান্য। গ্রাম্য পথ কর্দমাক্ত, পঙ্কিল, মাঠে কাদা জলের খেলা, অবিরল ধারাবর্ষণ, বজ বিদ্যুৎ ও ঝড় বন্যার ভয়াল রূপ সমস্ত তুচ্ছ করে বাংলাদেশের আবহমান কালের কৃষক সম্প্রদায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে এ সময় মাঠে মাঠে বীজ বােনে, চারাগাছ তােলে, চারাগাছ রােপণ করে। হেমন্তের পরিপূর্ণ খামারে যে রাশি রাশি সােনার ধান তােলা হবে, তার জন্য বর্ষার এই দুরূহ কৃচ্ছ সাধনা। স্নেহময়ী বর্ষাই বাংলাদেশকে করেছে শস্যশ্যামলা।

তার সারা বছরের অন্নবস্ত্র, তার আর্থিক সচ্ছলতা সবকিছুই নির্ভর করে বর্ষার প্রসন্নতা ও দাক্ষিণ্যের ওপর। অতিবর্ষণের ফলে বর্ষা তার স্নেহশালিনী রূপের পরিবর্তে ধারণ করে ভয়াবহ সর্বগ্রাসী রূপ। তখন প্রচণ্ড ঝটিকা ও বন্যার তাণ্ডবে বহু গ্রাম জনপদ ধ্বংস হয়, বহুপ্রাণ মৃত্যুর করালগ্রাসে নিপতিত হয়, ক্ষেতের ফসল এবং কোটি টাকা মূল্যের বহু সম্পদ বিনষ্ট হয়। তবু বর্ষা বাংলার জীবন সাধনা ও ভাব সাধনার অনন্য রূপকার। বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের মতাে সাংস্কৃতিক জীবন গঠনে ও বিকাশে বর্ষার অবদান অপরিসীম। বর্ষা বাঙালির মনকে করেছে সরস ও সৃষ্টিশীল।

সে অফুরন্ত ফসল ফলিয়ে বাঙালির হাতে তুলে দেয় অফুরন্ত অবসর ও আর্থিক সংগতি। বাংলা কবিতায় ও গানে পড়েছে আকাশের ঘূর্ণায়মান মেঘের স্নিগ্ধ সজল ছায়া। কবি জয়দেব থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বর্ষার কবিতা ও সংগীতের যেন অন্ত নেই। বর্ষা কেবল বাংলাদেশের মাটিকেই শ্যামল সরস করে নি, সে’ বাঙালির মনােভূমিকেও করেছে রসসিক্ত। সেই সঙ্গে বর্ষা তার কাব্য সংস্কৃতিকেও দান করেছে চির শ্যামলতা, চির নবীনতা।

বন্যা:

বন্যা বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য ঠিক তেমনি প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়াও বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য। কখনাে কখনাে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলস্ফীতি দেখা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে নদনদীতেও প্লাবন আসে। বর্ষা আর প্লাবনের এই অস্বাভাবিক অবস্থাই বন্যা। প্রতিবছর, খালবিল, নদীনালা, পুকুর ডােবা প্লাবিত হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যায়। এ সমস্যা দূর করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

বন্যার কারণসমূহ:

বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী মেঘনা, যমুনা ও পদ্ম সবগুলােরই উৎপত্তিস্থল ভারত। মূলত এ তিন নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণের হ্রাস বৃদ্ধির ওপরই বাংলাদেশের বন্যা নির্ভরশীল। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফগলা পানির আধিক্য বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের ভূমির উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালুর পরিমাণ বেশি নয় এবং বাংলাদেশ গড়ে সমুদ্রতটের তুলনায় মাত্র ৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, তাই এখানকার নদীগুলাের পলি বহন ক্ষমতা খুবই কম। ফলে প্রতিবছর নদীবক্ষে পলি জমাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষ সমস্ত নিচু জায়গা ভরাট করে তাতে তৈরি করেছে শহর, নগর ও নতুন নতুন ঘরবাড়ি। ফলে পানিপ্রবাহের অনেক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রকৃতিও এর প্রতিশােধ নিচ্ছে বন্যার সৃষ্টি করে। যে বন্যা ছিল স্বাভাবিক, সে বন্যা এখন হয়ে পড়েছে অস্বাভাবিক, নিষ্ঠুর ও নিয়ন্ত্রণাতীত।

বন্যায় সৃষ্ট অসুবিধাসমূহ:

বন্যা যে আমাদের কত ভয়াবহ অসুবিধা সৃষ্টি করে তা কেবল ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ভুক্তভােগী ছাড়া বন্যার করুণ রূপ অনুভব করা যায় না। বন্যা যখন তার স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে যায় তখন তার প্রতিক্রিয়া হয় খুবই মারাত্মক। জমির ফসল, ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। অনাহারে মানুষ মরে এবং বন্যাপরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে রােগব্যাধি, কখনাে, তা এমন মহামারি আকারে দেখা দেয় যে, মানুষ তখন মানবেতর জীবন যাপন করে।

বন্যা সমস্যার সমাধান:

বন্যা সমস্যার পুরােপুরি সমাধান অবশ্য সম্ভব নয়; তবে এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। যেমন—

  • যেসব স্থানে বন্যার পানি ১ থেকে ৩ ফুটের মধ্যে অবস্থান করে সেসব স্থানে ঘরবাড়ি বসতি স্থাপন না করে সেখানে প্রতিবছর বন্যার স্বাভাবিক প্রবাহকে প্রবাহিত হওয়ার সুযােগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
  • বর্ষা মৌসুমের বাড়তি পানি যেসব নদীনালা, খালবিল, শাখানদী ইত্যাদির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয় সেগুলাের নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, এভাবে বর্ষার অতিরিক্ত পানিকে চারদিকে ছড়িয়ে প্রবাহিত করে বন্যা সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেতে পারে।
  • নদীর উপচানাে পানি যাতে তীরবর্তী এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্থানবিশেষে মাটি, পাথর, সিমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে সাধারণ বাঁধ নির্মাণ করে বন্যাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • প্রাকৃতিক কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ নদনদী ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। তাতে বন্যার পানি নদীপথে সাগরে যেতে পারে না। প্রয়ােজনীয় খালখনন কর্মসূচি সম্পন্ন করা গেলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর তাহলে বন্যার প্রকোপ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।

উপসংহার:

বর্ষা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনলেও বন্যা কিন্তু অভিশাপ স্বরূপ। তাই বর্ষা আমাদের কাম্য হলেও বন্যা মােটেই কাম্য নয়। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্যার প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।


আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা রচনাঃ

0
0
0
0
0

Download Post

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *