বাংলা দ্বিতীয় পত্র
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার
“ মােরা তব আজ্ঞাবহ দাস
প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারী সর্বনাশ।”
—কাজী নজরুল ইসলাম
ভূমিকা:
বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ুর দেশ। মৌসুমি বায়ুর জন্য বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই ষড়ঋতুর জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর অকৃত্রিম প্রাকৃতিক লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আবার মৌসুমি বায়ুর কারণেই এই শ্যামল সুন্দরের লীলাক্ষেত্র পরিণত হয়েছে শ্মশানে। বাংলাদেশের ভৌগােলিক অবস্থানটাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখােমুখি। আমাদের দেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। তারই প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডাে, সাইক্লোন বা জলােচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও মহামারীতে দেশের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশে সাধারণত যে সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়, নিচে তার বর্ণনা দেওয়া হলাে
কালবৈশাখি:
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই নানা দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। কালবৈশাখির ফলে বাংলার বহু এলাকা বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ের তাণ্ডবলীলায় গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। মারা যায় হাজার হাজার গরু বাছুর, পাখপাখালি, মানুষ হয় অসহায়। কিছুদিন পূর্বে এমনি এক কালবৈশাখির শিকার হয়েছিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার জনসাধারণ। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবন এলাকা, ১৯৯১ সালে গাজীপুর এবং ১৯৯৬ সালে টাঙ্গাইলের অনেক থানা বিধ্বস্ত হয়েছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে বহু গ্রামগঞ্জ। প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের কোনাে না কোনাে অঞ্চলের ওপর দিয়ে এরকম কালবৈশাখি বয়ে যায়।
বন্যা:
বন্যাও বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ নিয়ে দেখা দেয়। ছােটখাট প্লাবনকে আমরা বলে থাকি বর্ষা। আর সেই প্লাবন যখন বিশাল আকার ধারণ করে তখন তাকে বন্যা বলা হয়। প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। দেশের নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে ভেসে যায়। কোনাে কোনাে বছর তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ধ্বংস হয় শত শত গ্রাম। মারা যায় গরু, বাছুর, মানুষ। নষ্ট হয় হাজার হাজার একর জমির ফসল। ১৯৭৪, ১৯৮৭ সালের বন্যায় আমাদের দেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা। যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ১৯৯৮ সালের বন্যায়ও কম ক্ষতি হয় নি। ২০০৩ সালের বন্যায়ও কোনাে কোনাে অঞ্চলে অনেক ঘরবাড়ি এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
সাইক্লোন বা জলােচ্ছ্বাস:
সাইক্লোন বা জলােচ্ছ্বাস বাংলাদেশের একটি উল্লেখযােগ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞলে প্রায় বছরই জলােচ্ছ্বাস হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিগত ১৮৫ বছরে বাংলাদেশে ৫১ বার সাইক্লোন সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের সাইক্লোন জলােচ্ছাস সবাইকে হতবাক করে দেয়। সেই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল আড়াইশ কিলােমিটার। বুদ্র কালনাগিনীরূপে ধ্বংসযজ্ঞ চলায় পাঁচ লাখেরও বেশি লােক মারা যায় জলােচ্ছ্বাসের ছােবলে। ১৯৮৫ সালেও বাংলাদেশের দক্ষিণের দ্বীপাঞলে হানা দেয়, সর্বনাশা সাইক্লোন। সাইক্লোনের প্রচণ্ড আঘাতে উড়ির চর এলাকা বিধ্বস্ত হয়। এ সময়ে প্রায় দেড় লাখের মতাে লােক প্রাণ হারায় এবং ধ্বংস হয় জমির ফসল ও অসংখ্য ঘরবাড়ি।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে সংঘটিত হয় স্মরণকালের আরও এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস। বাংলাদেশের ১৬ টি জেলার প্রায় ৪৭ টি থানা বিধ্বস্ত হয়। ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এই ঝড় হ্যারিকেনের রূপ নিয়ে ২০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় জলােচ্ছাস আঘাত হানে। ঐ প্রলয়ঙ্করী জলােচ্ছ্বাসে প্রায় পাঁচ লাখ লােক মারা যায়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ এই দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি আইলা, সিডর প্রভৃতি দুর্যেঅগে এ ক্ষতির পরিমাণ আরাে বেশি হয়।
টর্নেডাে:
বাংলাদেশে প্রায় বছরই টর্নেডাে বা আকস্মিক ঘূর্ণিবায়ু মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহতম টর্নেডাে আঘাত হানে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা ও তার আশেপাশের জেলাগুলােতে। এতে বহু প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংস হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। বিনষ্ট হয় হাজার হাজার গবাদিপশু।
লবণাক্ততা:
লবণাক্ততাও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় জমিতে প্রায় সময়ই লবণাক্ততা দেখা দেওয়ার ফলে ব্যাপকভাবে ফসলের ক্ষতি হয়।
শিলাবৃষ্টি:
শিলাবৃষ্টি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলাের একটি। প্রায় বছরই ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হয়। ফলে বিভিন্ন প্রকার ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ইরি ধানের মৌসুমে শিলাবৃষ্টি হলে কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। চারা অবস্থায় শিলাবৃষ্টি হলে ধানের ফলন অনেক কম হয়। ধান বের হবার পর শিলাবৃষ্টি হলে ধান চিটা হয় এবং ঝরে যায়।
ভূমিকম্প:
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছর ভূমিকম্প হয়। এতে কিছু পরিমাণ জনজীবন বিপর্যস্ত হয় এবং দালান কোঠা, ঘরবাড়ি ধসে যায়। অনেক সময় ধ্বসে যাওয়া ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে মানুষ ও গরু ছাগল প্রাণ হারায়।
নদীভাঙন:
নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অনেক এলাকা নদীভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন— পদ্মার তীরে বসবাসকারী লােকেরা নদীভাঙনের ফলে অনেকক্ষেত্রে, সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। যমুনা নদীর ভাঙনেও অনেক পরিবার সব হারা হচ্ছে।
খরা:
কৃষিপ্রধান দেশে খরা বা অনাবৃষ্টি একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে প্রায় বছরগুলােতেই খরা বা অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। যে বছরগুলােতে খরা বা অনাবৃষ্টি দেখা দেয়, সে বছর প্রায় সবরকম ফসলেরই ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। খরা বা অনাবৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
অতিবৃষ্টি:
কৃষিপ্রধান দেশে অতিবৃষ্টির ক্ষতিকর দিক কম নয়। বাংলাদেশে প্রায় বছরই অতিবৃষ্টির প্রকোপ দেখা দেয়। অতিবৃষ্টির ফলে ফসলের জমি পানিতে ডুবে যায়, কিংবা জমি থেকে পানি নিষ্কাশন দেরিতে হয়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে।
দুর্যোগ মােকাবেলার উপায়
বিভিন্ন উপায়ে এসব দুর্যোগ মােকাবিলা করা যায়। দুর্যোগ মােকাবিলার প্রধান প্রধান উপায়গুলাে নিম্নরূপ:
- দুর্যোগ মােকাবেলার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী গঠন করা।
- জাতীয় ভিত্তিতে দুর্যোগ মােকাবিলা করার নীতিমালা, পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা।
- জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে যােগাযােগ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা।
- পরীক্ষিত পদ্ধতির ভিত্তিতে যথাসময়ে সতর্কবাণী দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
- দুর্যোগ ঘটার পর দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা নিরূপণের ব্যবস্থা করা।
- তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থাকে উন্নত করা।
- দুর্যোগপূর্ণ এলাকাতে আশ্রয়স্থল গড়ে তােলা।
- বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানাে।
- বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে কাজে লাগানাে।
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কাজ করার সুযােগ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং
- শিক্ষার মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
উপসংহার:
দুর্যোগ সব সময়ই মানবতার জন্য বিপদ ডেকে আনে। তাই যেকোনাে দুর্যোগের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া মানবতার কাজ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকার অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফলে আমরা ভবিষ্যতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সময়ােপযােগী দুর্যোগ মােকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণে সক্ষম হতে পারব।