বাংলা ২য় পত্র
আমার ছেলেবেলা
সময়ের প্রবহমানতায় মানুষ নিয়তই সম্মুখের পথযাত্রী। এ সম্মুখযাত্রায় আজ আগামীকালে গিয়ে অতীত হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা সময়ের কাছে কখনো- হার মানে না, বরং সময়কে হার মানিয়ে সে ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি ঘোষণা করে। শৈশবের স্মৃতিও ঠিক তেমনি । কালের ধারায় কর্মব্যস্ত মানুষ তার শৈশবকে পেছনে ফেলে এলেও মনের গহীনে তাকে ধারণ করে সারাজীবন।
মানবজীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটে তার শৈশবে। বাধনহারা মানবশিশু আপন মনের কথা মেনেই শৈশবে তার দিন কাটায়। কোনো বাধা-নিষেধ, অন্যায়, অসুন্দর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই আনন্দ লাভ আর আনন্দদানই এ সময়ে তার একমাত্র কাজ। একটি শিশু কখনো দুঃখ নিয়ে চিন্তা করে না, সে কেবলই বসন্তের কোকিলের মতো আনন্দের সুর বাজায় । শৈশবের আনন্দময় স্মৃতিগুলো মানবমনে অঙ্কিত হয় চিরকালের আবেদন নিয়ে।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে চট্টগ্রাম জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম- মহাদেবপুরে। এ গ্রামের আলো, বাতাস, পাখির গান সবই মুগ্ধ করত আমাকে। মুগ্ধ মন নিয়ে দস্যিপনা করেছি সারা গ্রামজুড়ে । আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখময় দিনগুলো কেটেছে এখানে । আজ যখন শৈশবের দিনগুলো নিয়ে ভাবি তখন কত না বিচিত্র স্মৃতি মনের পাতায় ভেসে ওঠে। আনন্দপূর্ণ সে দিনকে ফিরে পাওয়ার জন্যে মন ব্যাকুল হয়। ইচ্ছে হয় আবার শৈশবে ফিরে যেতে।
আয়তনে আমাদের বাড়িটি মোটামুটি বড় ছিল। তিন দিকে তিনটি বড় ঘর ছিল_ একটা আমাদের, একটা মেজ চাচার, আরেকটা বড় চাচার, মাঝখানে অনেক বড়ো উঠোন। একপাশে ছিল বিশাল একটা পুকুর আর বাড়ির চারপাশে নানান প্রজাতির গাছের বাগান। বাড়িতে ঢোকার মুখে ছিলন ফুলের বাগান। আজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বাগানে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর থেকে শিউলি ফুল কুড়ানোর দৃশ্য। সব চাচাতো ভাইবোনরা মিলে উঠোন জুড়ে খেলেছি কখনো বউচি, কখনো কানামাছি, মাতিয়ে রেখেছি সারাবাড়ি। চাদনি রাতে উঠোনে পাটি বিছিয়ে সবাই মিলে বসত গল্পের আসর। দাদি ছিলেন এ আসরের মধ্যমণি। সব নাতি-নাতনিকে চারপাশে বসিয়ে একের পর এক বলে যেতেন রাজা-রানি,/রাজকন্যা আর রাক্ষসের গল্প । কখনো বলতেন ভূত-প্রেরেতের গল্প।
মনে পড়ে দাদি একবার ভূতের গল্প বলেছিলেন বলে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম । ভয়ে সে রাতে ঘুম হয়নি। দুদিন জ্বরে ভূগেছিলাম। আমার মাথায় হাত রেখে দাদি খুব কেঁদেছিলেন। আর কখনো তিনি ভূতের গল্প শোনাননি। এ ঘটনার তিন বছর পর দাদি মারা যান। শিশু হৃদয় দুঃখ বহন করে না, কিন্তু দাদিকে হারানোর ব্যথা এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। কেননা তিনি ছিলেন আমাদের পরম বন্ধু। অনেক দস্যিপনা করেও দাদির সহায়তায় আমরা বাবা-মায়ের বকুনি থেকে পার পেয়ে যেতাম। এই একটা দুঃখময় ঘটনা ছাড়া শৈশবে আর সব স্মৃতিই আমার জন্যে আনন্দের । চাচাতো ভাইবোনের সংখ্যা আটজন হলেও আমার সব দুষ্টমির সহচরী ছিল আমার সমবয়সী এক চাচাতো বোন। গ্রীষ্মের দুপুরে মা যখন আমাদের ঘুমানোর জন্যে বাধ্য করতেন, আমরা তখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গিয়ে উঠতাম আম গাছের মগডালে। পাকা আমগুলো পাড়ার লোভ আমাদের কিছুতেই বিছানায় থাকতে দিত না। কতদিন এ কাজের জন্যে মার কাছে বকুনি খেয়েছি। কিন্তু আমাদের চেহারা, চোখের চাহনি দেখে মা হেসে ফেলতেন। আজ সে বকুনি খাওয়ার জন্যে মন অস্থির হয়ে থাকে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।
শৈশবের অনেক স্মৃতি আছে স্কুলকে কেন্দ্র করে । মনে পড়ে প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ার কথা। অন্য ভাইবোনেরা সাথে থাকলেও প্রথমদিন বাবা সাথে গিয়েছিলেন। খুব আনন্দ আমার। গোল বাধল তখন যখন বাবা আমাকে ক্লাস রুমে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। সে মুহূর্তে আমার কান্না দেখে কে! সব শিক্ষক সেখানে এসে জড়ো হয়ে গেলেন, অনেক আদর করলেন, কিন্তু আমার কান্না থামাতে পারলেন না। অগত্যা বাবা আমাকে সাথে করেই বাড়ি ফিরলেন।
যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের স্কুলে অনেক আয়োজন করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। স্মরণশক্তি পরীক্ষা এবং একশ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হলাম। কিন্তু অঘটনটা ঘটল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়। আমরা একটা হাসির নাটকে অংশ নিয়েছিলাম আমার চরিত্রটা ছিল প্রধান শিক্ষিকার। সুতরাং, আমাকে শাড়ি পরানো হলো। কিন্তু হাটাটা আমার জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। কিছুতেই সামাল দিতে পারছিলাম না। ব্যস, মঞ্চে উঠতে গিয়ে মঞ্চের বাইরে সিঁড়িতেই আমি চিৎপটাং। এতগুলো মানুষের সামনে পড়ে লজ্জায় আমার চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। অন্য ছাত্রছাত্রীরা তখন দাঁত বের করে হাসছে। আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল, কিন্তু আজ সেকথা ভাবলে আমার নিজেরই হাসি পায়।
আমাদের বাড়ির পাশেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আমাদের ভাইবোনদের শখ ছিল গাড়ির সংখ্যা গোনা। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠতাম না। না পারার ব্যর্থতায় কষ্ট পেতাম খুব। ভাবতাম, আরেকটু বড় হয়ে নিই, ঠিকই পারব। এখন বড় হয়েছি, তাই সে কাজ এখন আর করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু সারি বেঁধে গাড়ি গণনার যে স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তা আমার শিশুমনের নির্মলতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।
শৈশবের স্মৃতিতে আরেকটা মুখ ভেসে ওঠে প্রতিনিয়ত। তিনি হলেন আমার একমাত্র মামা। আমাদের বাড়িতে আসার সময় তিনি অনেক মজার মজার ছড়ার ও গল্পের বই আনতেন। দল বেঁধে আমরা সবাই মামার সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কখনো পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম, আবার কখনো যেতাম একটু দূরে রেল লাইনের পাড়ে। রেলগাড়ি যাওয়ার সময় আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে বলতাম ঝিকবিক ঝিকঝিক। রেলের শব্দের সাথে মিলে যেত বলে খুব আনন্দ পেতাম। রেললাইন থেকে পাথর কুড়ানোতেই ছিল আমার আসল আনন্দ। কাজের সূত্রে মামা এখন দেশের বাইরে, কিন্তু তার সাথে আমার শৈশবের যে স্মৃতি তা এখনো অম্লান।
সময়ের আবর্তনে দিনের প্রহর ভাগের মতোই জীবনের প্রহরও ভাগ হয়। দিনের ক্ষেত্রে যেমন পালাক্রমে সকাল-দুপুর- সন্ধ্যা-রাত আসে, জীবনের ক্ষেত্রেও তেমনই আসে শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য। দিনের সুচনায় যেমন ভোরের মিষ্টি আলোর আবেদন চিরন্তন, তেমনই জীবনের যে পর্যায়েই মানুষ থাকুক না কেন শৈশবের স্মৃতি থাকে চির অগ্লান। বর্তমানকে নিয়ে মানুষ যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, বর্তমানের আড়ালে অতীত সবসময় সগর্বে বিরাজ করে। পেছনে ফেলে আসা সময় স্মৃতি হয়ে মানুষের অন্তরে আসন নেয়। কবিগুরুর ভাষায়__
‘বাহির হতে ভিতরেতে আপনি লহো আসন পেতে-
তোমার বাশি বাজাই আমি আমার প্রাণের অন্তঃপুরে।’
উপসংহার: আমার ছেলেবেলার আনন্দঘন মুহূর্তের সঙ্গিরা আজ সবাই কর্মব্যস্ত। জীবন গড়ার তাগিদে আজ সবাই বিচ্ছিন্ন। কিছুই আর আগের মতো নেই। তবুও শৈশবকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে হয় খুব। যদিও জানি শৈশবে ফিরে যাওয়া বা শৈশবকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। শুধু স্মৃতিতেই শৈশবকে ধারণ করে আছি মনের গহিনে। ব্যস্ত জীবনের মধ্যে শৈশবের নিষ্কণ্টক স্মৃতিগুলো আজও আমার মনে সোনালি স্বপ্নের মতো ভাসে।
এটা ঠিক আছে।
তবে যদি point গুলো দেওয়া থাকত তাহলে আর সুবিধা হত,,,,,🙂🙂